৬০ বছর বয়সী লাল মিয়া থাকেন বুড়িগঙ্গার তীরে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জে। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে মাছ ধরে আসছেন। চার বছর আগে বুড়িগঙ্গায় তাঁর জালে সারা শরীরে কাঁটাযুক্ত একধরনের মাছ ধরা পড়ে। পরে জানতে পারেন একে স্থানীয় লোকজন চগবগে মাছ বলেন। আর কেউ কেউ ডাকেন সাকার ফিশ নামে। শুরুর দিকে এই মাছ বেশি দেখা না গেলেও এখন জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে।
দেশের সবচেয়ে দূষিত এই নদীতে বর্ষাকালে অল্পস্বল্প হলেও মাছ পাওয়া যায়। বৃষ্টি বাড়লে বুড়িগঙ্গায় মেলে শিং, মাগুরসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ। কিন্তু আগের মতো এখন জালে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে না।
গত বুধবার (১০ নভেম্বর) লাল মিয়ার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কোত্থেকে আইল অদ্ভুত এই চগবগে (সাকার ফিশ) মাছ, ভেবে কূলকিনারা করতে পারি না। সারাক্ষণ এই মাছ কিলবিল করছে। এই মাছ তো কেউ খায়ও না।’
সেদিন দুপুরে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পন্টুনের পেছনের অংশজুড়ে দেখা গেল শত শত সাকার মাছ। দূষিত বুড়িগঙ্গায় যেখানে মাছের দেখা মিলত না, এখন সাকারে সয়লাব।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সাকার ফিশ দেশের বিভিন্ন জেলার নদ–নদীতে পাওয়া যাচ্ছিল, সে খবরটি আমাদের জানা। খুব শিগগির বুড়িগঙ্গা থেকে সাকার ফিশের নমুনা সংগ্রহ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এত দ্রুত কীভাবে সেখানে এরা বংশবিস্তার করল, সেই বিষয়ে গবেষণা করে দেখা হবে।
বিএফআরআই মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, সাকার মাছ দেশীয় প্রজাতির জন্য হুমকি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে জলাশয় কিংবা নদীতে সাকার মাছ থাকবে, সেগুলো সেখানকার দেশীয় প্রজাতির মাছের খাবার খেয়ে ফেলবে। অর্থাৎ দেশি প্রজাতির মাছগুলো শেষ পর্যন্ত খাবার কম পাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশি প্রজাতির মাছ।
সাকার ফিশের আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস। আশির দশকে অ্যাকুয়ারিয়ামের শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে এই মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়। এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে।
সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর দাঁতও বেশ ধারালো। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
আবদুর রহিম সদরঘাট এলাকার একজন দিনমজুর। সদরঘাটের পন্টুনে লঞ্চ ভিড়লে তিনি যাত্রীদের মালামাল আনা–নেওয়ার কাজ করেন। কাজ শেষে টার্মিনালে ঘুমিয়ে পড়েন, গোসল করেন বুড়িগঙ্গায়। তবে এখন বুড়িগঙ্গায় গোসল করতে ভয় পান। কারণ হিসেবে আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুড়িগঙ্গায় এত বেশি চগবগে মাছ, গোসল করতেও ভয় লাগে। অনেকের গায়ে মাছের পাখনা ফুটেছিল, সেখানে পচনও ধরেছিল। চগবগে মাছ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ সয়লাব হওয়ার বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা (মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা) মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুড়িগঙ্গায় প্রচুর সাকার মাছ রয়েছে। বিদেশি এই মাছ এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আমাদের দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য হুমকি।’
ভারত ও মিয়ানমারে এই মাছ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সাকার মাছ দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য কতখানি হুমকি, সেটি নিয়ে গবেষণা জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিদেশি সাকার ফিশ দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য হুমকি, সেটি সাধারণভাবে বলা যায়। তবে মাছটি নিয়ে গবেষণা জরুরি। তখন জানা কিংবা বোঝা যাবে, বিদেশি প্রজাতির এই মাছ আমাদের দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য কতখানি ক্ষতিকর।’
যোগাযোগ করা হলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন।